একই সময়ে সমান্তরালভাবে নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দল আওয়ামী
লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
একদিকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়া প্রশাসনের সাথে গোলটেবিল বৈঠক
চলছিল। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন পরাশক্তির সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণ
মেলানোর কাজ চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত
জোসেফ ফারল্যান্ড এর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। উক্ত আলোচনায় যেকোনো
পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমেরিকার সমর্থন আশা করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা কি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল???
এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন যুক্তিতর্ক সমাজে প্রচলিত
আছে। অনেকেই মনে করেন আমেরিকা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী। তারা তাদের
সর্বশক্তি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানকে যুদ্ধের জন্য
প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। অর্থনৈতিক সহায়তা সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একচেটিয়াভাবে সমর্থন করে গিয়েছে। বাংলাদেশ
যেনো স্বাধীন হতে না পারে সেই জন্য আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে চেয়েছিল।
আবার অনেকেই মনে করেন আমেরিকান জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে থাকলেও আমেরিকার
সরকার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।
উপরে উল্লেখিত যুক্তিতর্ক সময়ে সময়ে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী
এবং রাজনৈতিক দলের হাইপোথিসিস ছিলো বললে ভুল হবেনা। কারন সেই সময়ে এটা জানা কারো পক্ষেই
সম্ভব ছিলো না, আমেরিকা
ঠিক কি স্ট্যান্ড নিয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রায় ৪০-৪৫ বছর পর আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধে
তাদের অবস্থান, ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত অনেক ডকুমেন্টারি এভিডেন্স
জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ফলে এই প্রথম মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার অবস্থান
কি ছিল তা তাদের বয়ানেই জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বহুকাল ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে
আমেরিকার অবস্থান নিয়ে যে ধোয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান ঘটানো সম্ভব এই সকল ডকুমেন্ট-এ
বিদ্যমান তথ্য বাংলাদেশের আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দিতে পারলে।
পিনাকী ভট্টাচার্য, বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অনলাইন
এক্টিভিস্ট এবং গুনী লেখক, যিনি খুব যত্ন সহকারে তাঁর লেখা বই “মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’৭১”
–এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আমেরিকান ডকুমেন্ট মূল্যায়ন করে সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে
আমেরিকার অবস্থান কি ছিলো তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন
হাইপোথিসিস এবং বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বের গড়ে তোলা বয়ানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন,
ভেঙ্গে দিয়েছেন তাদের গড়ে তোলা বহুদিনের পুরোনো বয়ান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে অনিবার্য ছিল সেটা আমেরিকা ১৯৭১
সালের মার্চের শুরুতেই বুঝতে পারে। তাদের সঙ্কা ছিল এই বিচ্ছিন্ন হওয়াটা কি শান্তিপূর্ণ
উপায়ে হবে নাকি রক্তাক্ত উপায়ে হবে সেই বিষয়ে। সেই সাথে তাদের আরো সঙ্কা ছিল যুদ্ধের শেষ সময়ে ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ করতে
পারে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময় আমেরিকা উদ্বিগ্ন ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের অখন্ডতা এবং অর্থনীতি নিয়ে। যেহেতু
তারা জানতো বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই তাই তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেই ভাবেই পরিকল্পনা
করে। সেই সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম সাহায্য তারা বাংলাদেশের
প্রবাসী সরকারকে প্রদান করে। একই সাথে পশ্চিম-পাকিস্তান যেন কোনোভাবেই ভারত দ্বারা
আক্রান্ত না হয় সেই জন্য সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর মত স্বিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করে। যা কোনোভাবেই
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে ছিলো না।
সেই সময়ে আমেরিকা চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার কাজ করছিলো।
যার মধ্যস্থতাকারী ছিলো পাকিস্তান। যার কারনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তান আমেরিকার
জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছিলো। তাই আমেরিকা চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের
মত সাপোর্ট সেই সময়ে বাংলাদেশকে দিতে পারতো না। অবশ্য যুদ্ধের শেষ সময়ে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা একাট্টা হয়ে কাজ করেছিলো।
“মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’৭১” বইটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অতি মূল্যবান সম্পদ। ইতিহাসের নানা অজানা দিক এবং সত্যের দুয়ার খুলতে বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সমাজে প্রচলিত ভুল ধারনা এবং আমেরিকার প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করার জন্য আপামর মানুষের যে ক্ষোভ এবং বিদ্বেষ তা কমাতে বইটি অনেকাংশেই সাহায্য করবে। বইটির মাধ্যমে সবচাইতে বড় যেই কাজটি হবে সেটি হলো সত্যের দ্বার উন্মোচোন, যা ভবিষ্যতে গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে থাকবে।
আমেরিকা কি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলো? আপনারা চাইলে আলোচোনাটি শুনতে পারেন। আশা করি উত্তর পেয়ে যাবেন।
No comments:
Post a Comment