বর্তমান সময়ে পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে তুমুল আলোচোনা এবং সমালোচোনা চলছে। কেঊ বলছেন পোশাক পরা তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, আবার অনেকেই বলছেন কেউ চাইলেই যেকোনো পোশাক পরতে পারবেন না। সামাজিকতা এবং কৃষ্টি-কালচার মেনে পোশাক পরতে হবে। আজকের লেখাতে আমরা দেখবো আসলেই পোশাক পরিধান করা কারো ব্যক্তি স্বাধীনাতা কি না এবং একজন ব্যক্তি ঠিক কতটুকু পর্যন্ত স্বাধীন তার পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
আলোচোনার শুরুতেই প্রথম যে প্রশ্নটার উত্তর আমরা খুঁজবো সেটা হলো পোশাক কি? এটা কি লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য শুধু? নাকি এটা স্টাইল ও ফ্যাশনেরও প্রতিক? নাকি এটা লজ্জাস্থান ঢাকার পাশাপাশি শালীনতা বজায় রাখারও মাধ্যম?
যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর হয় লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য, তাহলে আপনি ঠিক উত্তর টাই জানেন। আবার যদি আপনি মনে করেন যে পোশাক স্টাইল ও ফ্যাশনের প্রতিক, তাহলেও আপনি ঠিক উত্তরটাই জানেন। আপনারা যারা মনে করেন পোশাক স্টাইল ও ফ্যাশনের প্রতীক, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আপনারা এটাও মানেন, পোশাক শরীরের প্রাইভেট পার্ট ঢেকে রাখার জন্যেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যদি সেটাই হয়, তাহলে সোজা কথাই বলা যেতে পারে পোশাক এর অন্যতম বা, প্রধানতম কাজ হলো লজ্জাস্থান কে আবৃত করে রাখা বা শালীনতা বজায় রাখতে সাহায্য করা। দ্বিতীয় বা, গৌণ কাজটি হলো ফ্যাশন।
আদি কালে যখন পোষাক ছিল না, তখন মানুষ গাছের পাতা দিয়ে লজ্জাস্থান কে আবৃত করে
রাখতো। নিশ্চয় ফ্যাশন করার জন্য গায়ে পাতা কিংবা মৃত পশুর চামড়া
জড়িয়ে রাখতো না! এই লাইন দিয়েই এতটুকু বোঝা যাই পোশাকের প্রধানতম
কাজ কোনটা আর গৌণ কাজ কোনটা। আপনি আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন, সেই অধিকার আপনার
আছে।
আমরা আরো বলতে পারি পোশাক শুধু আমাদের শালীনতা বজায় রাখতেই সহযোগিতা করেনা, বরং এটা দিয়ে আমরা স্টাইল ও ফ্যাশন করতে পারি। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি স্টাইল কিংবা ফ্যাশন করছেন? নাকি অন্য কিছু? এখন যেই প্রশ্নটা আসে, সেটা হলো স্টাইল বা ফ্যশন কি?
According to
Wikipedia, Fashion is a form of self-expression, at a particular period and
place and in a specific context, of clothing, footwear, lifestyle, accessories,
makeup, hairstyle, and body posture.
আমি যদি বাংলায় খানিকটা বলি, তাহলে ফ্যাশনের ডেফিনিশনটা দাড়ায় কিছুটা এমন--- নির্দিষ্ট সময়, স্থান এবং নিদৃষ্ট প্রসঙ্গে আপনার আত্মপ্রকাশ। সেটি হতে পারে আপনার পোশাকের মাধ্যমে, জীবন যাপনের মাধ্যমে কিংবা আপনার মেকাপ, হেয়ার স্টাইল ইত্যাদির মাধ্যমে। আপনি যদি ইংরেজি বুঝেন তাহলে খুব স্পষ্ট ভাবে একটা শব্দ দেখবেন, সেটা হলো পার্টিকুলার পিরিয়ড এন্ড প্লেস।
আপনি যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান নারীরা শর্টস পরছেন। অ্যারাবিয়ান বা, মধ্যপ্রাচ্যের মেয়েরা বোরকা বা হিজাব পরেন। বাংলাদেশের মেয়েরা পরেন শাড়ি, আমি যদি ভুল না বলে থাকি। এই সব ক্ষেত্রেই একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, সেটা হলো নিদৃষ্ট সময়, স্থান এবং প্রসঙ্গ। আরেকটা ব্যাপার হলো, আপনি নিশ্চয়ই স্কুলে যাবার সময় স্কুল ড্রেস ছাড়া অন্য কিছু পরেন না, আবার বিয়ের অনুষ্ঠানেও নিশ্চয় স্কুল ড্রেস পরে আসেন না। এইটা নির্ভর করে আপনি কোথায় যাচ্ছেন তার উপর। এইটা ছিল স্পেসিফিক টাইম এন্ড কন্টেক্সট এর উদাহরণ।
আবার সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং অস্ট্রিয়াতে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপনি চাইলেও সেখানকার পাবলিক প্লেসে হিজাব পরতে পারবেন না। আপনার বাড়িতে আপনি পরতে পারেন, সমস্যা নাই। কিন্তু পাব্লিক প্লেসে পরতে পারবেন না। এটা মানতে আপনি বাধ্য।
এখন আসি বাংলাদেশে, এখানে আপনি মোটামুটি
ফ্রিস্টাইলে চলতে পারবেন, সমস্যা হবে না। যা ইচ্ছা আপনি পরতে পারবেন, কোনো সমস্যা নাই।
আইনে কি বলা আছে সেটা আপনার না জানলেও চলবে। এখানে বেশির ভাগ কাজ এবং কাজের বিচার হয়
নৈতিকতা কিংবা এথিক্স দিয়ে। আপনি যদি ওয়েস্টের্ণ পোশাক পরেন তাহলে আপনাকে সবাই এত্তগুলা
নৈতিক বাক্য শুনিয়ে দিয়ে চলে যাবে। কিছু পোংটা পোলাপাইন আপনাকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য
করবে। আর আপনিও তাদের উপর এত্তগুলা যুক্তি কিংবা গালি দিবেন এই বলে যে, অন্য দেশের
মেয়েরা তো পরে তাদের দেশের ছেলেরা কি এত বাজে কথা বলে? কিংবা বলে বসবেন এদেশের ছেলেদের
মস্তিষ্কে মরিচা কিংবা সমাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাবতে আমার খুব ভালোই লাগে কি সুন্দর
নৈতিক প্রশ্নের নৈতিক উত্তর। মারহাবা। সহিহ না?
আপনি ফ্যাশনের নামে কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরেন, যেটা কিনা টাইম কিংবা কন্টেক্সট কিংবা নৈতিক নারী-পুরুষদের নৈতিকতার মানদন্ডেও উত্তির্ণ না। তার মানে হলো আপনি আর যাই করছেন ফ্যাশন করছেন না মোটেও। যেটা আপনার ব্যাক্তিত্ব কে তো প্রকাশ করেই না, বরং আপনাদের মতো নৈতিক নারী-পুরুষরাই সমাজের অধঃপতনের জন্য দায়ী। আপনারা না পারেন গঠন মূলক সমালোচনা করতে না পারেন সেটা মেনে নিতে। পারেন শুধু বাজে কথার মাধ্যমে সমাজ নষ্ট এটা প্রমান করার যুদ্ধ করতে। নিজে কতটুকু ভালো বা মন্দ সেটা বিচার না করেই সব দোষ আমরা সমাজকে দেই। তার আগে এতটুকু ভেবেছেন কি, যে আপনার সমাজ ব্যবস্থা কেমন বা এই সমাজে কি চলে বা এই সমাজ আপনার ওয়েস্টার্ণ পোষাক ধারণ করার মত যায়গাতে আছে কি না ? বা আপনি এমন কি করেছেন যেটার মাধ্যমে সমাজ আপনার বলা কথা কিংবা পোষাক কে সাদরে গ্রহন করবে? কিছুই করেন নাই আপনারা। যা করেছেন তা হলো কাঁদা ছোড়া-ছুড়ি।
সমাজ কখনোই নতুন জিনিস গ্রহন করতে চাই না। সে ভয় পাই, অজানা ভয়। সমাজে নতুন কিছু প্রবেশ করাতে হলে সমাজকে সেই জিনিস ধারণ করার জন্য প্রস্তুত করতে হয়। সর্বপরি অশালীন পোশাক পরে আপনি অপরাধ করছেন বাংলাদেশের আইনে। সেটি আপনার জানা উচিত।
পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ২(গ) অনুযায়ী, ‘পর্নোগ্রাফি’’ অর্থ—
(১) যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন
নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা
অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই;
(২) যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি,
কাটুর্ন বা লিফলেট;
(৩) উপ-দফা (১) বা (২) এ বর্ণিত বিষয়াদির নেগেটিভ ও সফট ভার্সন;
যেহেতু, আইন অনুযায়ী উপরিউক্ত বিষয়গুলো অপরাধ (সঙ্গা নিয়ে মতবিরোধ আছে), তাই আপনি অপরাধ
করছেন। এটা মাথায় রাখতে হবে। আইন আমরা মানতে বাধ্য, ইহা বাইন্ডিং ফোর্স। বই কিংবা কোনো
ফিলোসোফি আমরা মানতে বাধ্য নই, ইহা পারসুয়েসিভ ফোর্স। তবে কেউ ব্যাক্তিগত ভাবে যেকোনো
মত অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু আইন মানতে আমরা বাধ্য। আরেকটা ব্যাপার, আপনি সমাজ পরিবর্তন
করতে গেলে নেতিবাচক অনেক কিছুই আসবে, সেগুলোকে হাসি মুখে সহ্য করে নিতে হবে। তবেই পরিবর্তন
সম্ভব।
এখন প্রশ্ন হলো পোশাক পরা কারো ব্যক্তি স্বাধীনতা কি না! এর উত্তর হচ্ছে অবশ্যই পোশাক পরা ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। তবে এই স্বাধীনতা absolute না। আপনি স্বাধীন ভাবে যে কোনো পোশাক পরতে পারবেন তবে আপনি এমন কোনো পোশাক পরতে পারবেন না, যেটা আইনের পরিপন্থী হয় এবং সমাজ যেটাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই সাথে আপনি কোনো আশালীন এবং কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরতে পারবেন না। আমাদের কন্সটিটিউশনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, No person shall be deprived of life or personal liberty save in accordance with law.
No comments:
Post a Comment