সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড নাকি ধর্ষণ মুক্ত সমাজ !!! - Suo Moto

Breaking

Sunday, October 11, 2020

সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড নাকি ধর্ষণ মুক্ত সমাজ !!!


ইদানিং আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছে। ফলে নাগরিক সমাজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছ।বিচার হীনতার সংস্কৃতি, আইনের শাসন না থাকা,রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সহ অনেক কারনেই ধর্ষণ আজ মহামারি রুপ নিয়েছে।কোনোভাবেই যেন মহামারি থামতে চাই না।এদিকে সমাজের নানা স্তরের মানুষ ধর্ষণের মত অপরাধ নির্মুলের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।তাদের অনেকেরই দাবি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যেন মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।ইতিমধ্যে সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার বিধান সংযুক্ত করার কথা ভাবছে।কি হবে যদি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়!!! আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হলে সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করা যাবে।কিন্তু আসলেই কি তাই? চলুন আমাদের দেশের আইন কি বলে একটু দেখে আসি। নারী শিশু নির্যাতন দমন আইন,২০০০ এর ধারা () অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড। ধারা () অনুযায়ী ধর্ষণের ফলে নারী কিংবা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষকের সাজা যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ড এবং ধারা () অনুযায়ী সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে প্রত্যেককেই ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড কিংবা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেয়ার বিধান আছে।তার মানে হলো নতুন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারন নেই।যদি এই আইনের সঠিক প্রয়োগ করা যেত, প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা যেত এবং দ্রুত বিচার করার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে খুব সহজেই ধর্ষণের হার কমে যেত। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে ধর্ষণের পর মারা গেলে কেন মৃত্যুদন্ড দিতে হবে বরং ধর্ষণ করলেই মৃত্যুদন্ড বিধান করতে হবে তাহলে ধর্ষণ কমে যাবে। দাবি অবশ্য করাই যায় কিন্তু আমাদের কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে এই দাবি করার আগে।

) শুধুমাত্র ধর্ষণ কি মৃত্যুদন্ড দেবার মত অপরাধ কি-না?
) আমরা কি এমন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলছি যেটা শুধু মাত্র শাস্তি বিধান করে?
) আমরা কি ধর্ষণ মুক্ত সমাজ চাই নাকি ধর্ষকদের ফাঁসি চাই?

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা আছে,আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবেনা।তার মানে আমরা চাইলেই কোনো ব্যক্তির জীবন কেড়ে নিতে পারিনা।তবে আইন যদি চাই তাহলে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায়।ক্ষেত্র গুলো হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে,বিদ্রোহ করলে, মিথ্যা স্বাক্ষী দেবার ফলে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু হলে,কাউকে খুন করলে বা খুন করার চেষ্টা করলে এবং অপহরণ করলে।শুধুমাত্র ধর্ষণের কারনে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান বাংলাদেশে নেই।বিশ্বের উন্নত দেশ যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড,ফ্রান্স, কানাডা,রাশিয়া  ইত্যাদি দেশেও শুধুমাত্র ধর্ষণের অপরাধে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান নেই।এইসকল দেশগুলোতে ধর্ষনের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ১৯৭৭ সালে আমেরিকার সুপ্রিমকোর্ট  চোকার বনাম, জর্জিয়া  মামলায় ধর্ষণের ফলে মৃত্যুদন্ড দেয়াকে নৃশংস এবং অপ্রয়োজনীয় শাস্তি হিসেবে রায় দেন। ২০০৮ সালে কেনেডি বনাম, লাওইসিয়ানা মামলায় একই রায় বলবৎ রাখেন শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে।

শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন।বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫() অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অমানুষিক কিংবা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাবেনা।মানবাধিকার সম্পর্কিত ইউরোপীয় কনভেনশন এর অনুচ্ছেদে নির্যাতন, অমানবিক আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।এমনকি সেটা অপরাধীদের ক্ষেত্রেও নয় এবং যুদ্ধের সময়েও নয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মৃত্যুদন্ডকে মানবাধিকারের  চূড়ান্ত অপরিবর্তনীয় লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন।এটি কেবল জীবনের অধিকারকেই লঙ্ঘন করেনা বরং নিষ্ঠুর অবমাননাকর আচরণের শিকার না হওয়ার অধিকারকেও লঙ্ঘিত করে।মানবাধিকার কাউন্সিল ২০০৯ সালে বাংলাদেশকে মৃত্যুদন্ড বিলোপের জন্য জোরালে ভাবে সুপারিশ করেছিল।

যদি ধর্ষণের ফলে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান করা হয় তাহলে ধর্ষিতার জীবন সংটে পড়বে এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার হার বেড়ে যাবে।কোনো ধর্ষকই চাইবেনা ধর্ষণের একমাত্র স্বাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখতে।ধর্ষণের একমাত্র স্বাক্ষী মৃত্যুবরণ করলে ধর্ষককে শনাক্ত করা কঠিন হবে এবং অনেক সময় ধর্ষককে শনাক্ত করতে না পারার কারনে বিচার ব্যহত হবে। আবার শক্ত প্রমাণ না থাকার কারনে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকেই বেরিয়ে যাবেন।যদিও বর্তমানে প্রযুক্তির সহায়তায় অপরাধী শনাক্তকরণ খুব কঠিন কিছু না।কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় আমরা কি ভিক্টিম কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি না তো? আমরা কি সেই রোমানদের মত "চোখের বদলে চোখ" বিচার ব্যবস্থাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করছি না তো?

বিচার ব্যবস্থার কাজ কি শুধুই শাস্তি বিধান করা নাকি সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং সঠিক পথ দেখিয়ে দেশ জাতিকে সাফল্য মন্ডিত করা? শুধু শাস্তি বিধান না করে কিভাবে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করা যায় সেই দিকটাও বিচার বিভাগকেই দেখতে হবে। কিন্তু আমরা এমন একটি বিচার ব্যবস্থা এবং বিচারিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি  যেখানে অপরাধ নির্মূল এবং অপরাধের প্রকৃত কারন খোঁজার চেষ্টা না করে শাস্তি বিধান করে চলেছে অবিরত ।ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।অপরাধ তো কমছেই না সেই সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা এমন এক বিচার ব্যবস্থা চাই যেখানে শাস্তি বিধানের চাইতে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা বেশি থাকবে।তাহলেই সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করা সহজ হবে।

তৃতীয় প্রশ্নটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে, আমরা কি ধর্ষণমুক্ত সমাজ চাই নাকি ধর্ষকদের ফাঁসি চাই?
ধর্ষকদের ফাঁসি দিলে যদি ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়া যেত বা ধর্ষণ কমে যেতো তাহলে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতো আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।ধর্ষকদের ফাঁসি দিলে কেবল ধর্ষকরা মারা যাবে।কিন্তু ধর্ষণের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবোনা।কারণ পুরোনো ধর্ষকদের যায়গা নতুন ধর্ষকরা দখল করবে। তাই আমাদের এমন সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে যেখানে ধর্ষকদের ফাঁসি দিতে হবেনা বরং নারীর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধাবোধ থাকবে সবার, মেয়েরা রাস্তায় ভীতি নিয়ে চলবে না,লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য থাকবে না। এর জন্য আমাদের ধর্মীয় সামাজিক মুল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে এবং আকাশ সংস্কৃতি পরিহার করে নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি লালন করতে হবে।সর্বপরি অদূর ভবিষ্যতে ধর্ষণ মুক্ত সমাজের প্রত্যাশা করি।

No comments:

Post a Comment